ইসলামী সংগঠনে আনুগত্য, পরামর্শ ও ইহ্তিসাব
ইসলামী সংগঠনে আনুগত্য, পরামর্শ ও ইহ্তিসাব
মূলঃ মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন
ইসলামী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাঃ
- ১. সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ফরয (ইমরান-১০৩)
- ২. আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার জন্য (সফ-৪)
- ৩. সংগঠন কায়েম করা নবীর তরীকা (আশ-শুরাঃ১৩)
- ৪. সংগঠন করা মহানবী (সাঃ)-এর নির্দেশ (৫ কাজের নির্দেশ-তিরমিযী)
- ৫. জাহিলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য (মুসলিম)
- ৬. (ইসলামী) সংগঠন ছেড়ে দেয়া ইসলাম ছেড়ে দেয়ার শামিল (আবু দাউদ)
- ৭. বিচ্ছিন্নতাবাদী জাহান্নামে যাবে (তিরমিযী)
আনুগত্য কি?
আনুগত্য শব্দটি ৩টি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা-
- ১. সংগঠনে অর্ন্তভুক্ত হয়ে যাওয়া
- ২. কুরবানী করা (মতের, অর্থের, সময়ের, শ্রমের, আরামের)
- ৩. উচ্চতর শক্তির বা ব্যক্তির আদেশ মানা
ইসলামী সংগঠনে আনুগত্যের গুরুত্বঃ
- ১. আনুগত্য করা ফরয (নিসা-৫৯)
- ২. হেদায়াত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত (নূর-৫৪)
- ৩. আনুগত্যহীনতা আমলকে বরবাদ করে দেয় (মুহাম্মাদ- ৩৩)
- ৪. ঈমানের অপরিহার্য দাবি (নূর-৫১)
- ৫. আনুগত্য সৎ কাজে, অসৎ কাজে নয় (মায়েদা-২)
- ৬. পছন্দ না হলেও আনুগত্য ফরয (বুখারী ও মুসলিম)
- ৭. যথাসাধ্য আনুগত্য করা ফরয (বুখারী ও মুসলিম)
- ৮. আনুগত্যহীনতার পরিণাম ভয়াবহ (জাহিলিয়াতের মৃত্যু)
- ৯. হাবশী গোলামও যদি আমীর হয়, তাহলে তারও আনুগত্য করে যেতে হবে (বুখারী)
- ১০. প্রাপ্য অধিকার না পেলেও আনুগত্য করতে হবে (মুসলিম)
- ১১. আমীরের আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য পূর্ণ হয় (বুখারী ও মুসলিম)
- ১২. নেতার মধ্যে অপ্রীতিকর কিছু দেখলে ধৈর্য-ধারণ করা উচিত (বুখারী ও মুসলিম)
- ১৩. দায়িত্বশীলের সাথে বিতর্কে জড়ানো ঠিক নয় (বুখারী ও মুসলিম)
অনুসরণীয় আনুগত্যের উদাহরণঃ
- ১. আবু বকর (রাঃ) কর্তৃক দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে ঘুমানো
- ২. উমর (রাঃ) এর নির্দেশ পালনে খালিদ (রাঃ) এর আনুগত্য
- ৩. হুদায়বিয়ার সন্ধিস্থলে আবু জান্দাল (রাঃ)-এর উপস্থিতি
কাদের বা কিসের আনুগত্য করতে হবেঃ
- ১. আল্লাহ, রাসূল, নেতা
- ২. সংবিধান, ঐতিহ্য, কর্মনীতি
- ৩. প্রতিনিধি, চিঠি, সার্কুলার, ঘোষণা
- ৪. সাংগঠনিক সিস্টেম, নিয়ম-শৃক্সক্ষলা ও সাংগঠনিক সিন্ধান্তের
আনুগত্য করার পূর্বশর্তঃ
- ১. মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ
- ২. দায়িত্বশীলদের প্রতি আস্থা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ
- ৩. ভালবাসা, দরদ ও আন্তরিকতা
- ৪. কল্যাণ কামনা
- ৫. আনুগত্যের ভারসাম্য রক্ষা
- ৬. স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য
- ৭. কৃত্রিমতা ও আনুষ্ঠানিকতা পরিহার
- ৮. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায়
- ৯. সমসয় ও দুঃসময়ের পার্থক্য না করা
- ১০. ব্যক্তির পরিবর্তনে আনুগত্য পরিবর্তিত না হওয়া
কর্মী ও দায়িত্বশীলের করণীয়ঃ
- ১. কর্মীর দায়িত্ব হলো নিজের সমস্যার চেয়ে সংগঠনকে গুরুত্ব দেয়া
- ২. নেতার দায়িত হলো কর্মীর সমস্যাকে মূল্যায়ন করা
আনুগত্যের ক্ষেত্রে বর্জনীয়ঃ
- ১. খিটখিটে মেজাজ
- ২. তর্ক-বিতর্ক
- ৩. সংবাদদাতার কাছে রাগ প্রকাশ
কিসে আনুগত্য নষ্ট করেঃ
- ১. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়াকে অগ্রাধিকার
- ২. আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অসচেতনতা
- ৩. গর্ব-অহংকার
- ৪. হিংসা-বিদ্বেষ
- ৫. সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি মনোভাব
- ৬. মেজাজের ভারসাম্যহীনতা
- ৭. পদের প্রতি লোভ
- ৮. দায়িত্বশীল পছন্দ না হওয়া
- ৯. মান উন্নয়নে বিলম্ব
- ১০. দায়িত্বশীলদের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা
- ১১. সন্দেহ প্রবণতা
- ১২. মতামতের কুরবানী করতে না পারা
- ১৩. হৃদয়ের বক্রতা
- ১৪. মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন
- ১৫. বন্ধু-বান্ধবদের দাবি পূরণ
- ১৬. পরিবার-পরিজনের চাপ
- ১৭. নিজকে অতীব যোগ্য মনে করা
- ১৮. সুযোগ-সন্ধানী ও সুবিধাবাদী মন-মানসিকতা
আনুগত্য পেতে হলে দায়িত্বশীলদের করণীয়ঃ
- ১. কর্মীদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ
- ২. জনশক্তিকে কুরআন-সুন্নাহ থেকে সংগঠন বুঝতে প্রেরণা দেওয়া
- ৩. কর্মীদের প্রতি নম্র, কোমল ও রহমদিল হওয়া
- ৪. অধস্তন ভাইদের দোষ-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা
- ৫. সহযোগীদের সাথে পরামর্শ করা
- ৬. সাংগঠনিকভাবে গৃহিত সিদ্ধান্তে অটলতা
- ৭. কর্মী ভাইদের জন্য দোয়া করা এবং পরস্পর দেয়ার
পরিবেশ তৈরি করা ইসলামী সংগঠনে পরামর্শঃ
‘‘হে নবী! কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। কোন বিষয়ে
আপনার পরিকল্পনা সুদৃড় হয়ে গেলে আল্লাহর উপর ভরসা করুন।’’ (বাকারাহ-১৫৪)
পরামর্শ কি?
পরামর্শ শব্দের শাব্দিক অর্থ হল মতামত দেওয়া, মত বিনিময় করা।
একে আরবিতে বলে ‘শূরা’। ইংরেজিতে বলে কাউন্সিল, এডভাইস।
একে আরবিতে বলে ‘শূরা’। ইংরেজিতে বলে কাউন্সিল, এডভাইস।
পরামর্শের গুরুত্বঃ
- ১. পরামর্শ দেওয়া আল্লাহর নির্দেশ (ইমরান-১৫৯)
- ২. পরামর্শ করা বিশ্বনবী (সাঃ)-এর সুন্নাত (তিরমিযী)
- ৩. পরামর্শ করা সাহাবাদের বৈশিষ্ট্য (আশ-শূরাঃ৩৮)
- ৪. পরামর্শ হচ্ছে আন্দোলনের নিরাপত্তা প্রহরী (আল মু’জামুস সগীর)
- ৫. পরামর্শে আল্লাহর রহমত থাকে
- ৬. পরামর্শ স্বেচ্ছাচারী হবার পথ রুদ্ধ করে
- ৭. ওহী ও নবীর অবর্তমানে জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য পরামর্শ জরুরী
- ৮. পরামর্শ চিন্তার ঐক্য সাধন করে (আবু দাউদ)
- ৯. পরামর্শ দুনিয়ার জীবনেরও কল্যাণ ও সৌভাগ্যের উৎস। (তিরমিযী)
পরামর্শ যারা দেবেন বা পরামর্শ যাদের সাথে করবেনঃ
- ১. সর্বসাধারণের পরামর্শ
- ২. দায়িত্বশীলবৃন্দের পরামর্শ
- ৩. আহলে রায় বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
পরামর্শ দেওয়ার নিয়ম-নীতি ও শর্তাবলীঃ
- ১. কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্যে পরামর্শ দেওয়া
- ২. দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে পরামর্শ চাওয়া
- ৩. মার্জিত ভাষায় পরামর্শ দেওয়া
- ৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পরামর্শ দেওয়া
- ৫. পরামর্শ গৃহীত হল কিনা তা বিবেচনা না করে পরামর্শ দেওয়া
- ৬. পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে গ্রুপিং না করা
- ৭. ক্ষতিকর পরামর্শ না দেওয়া (আবু দাউদ)
- ৮. সামষ্টিক মতের কাছে নিজের মতের কুরবানী দেওয়া (বায়হাকী)
- ৯. নিজের মতের বিপরীত সিদ্ধান্ত হলে তা বাইরে প্রকাশ না করা
ইহতিসাব কি?
ইহতিসা শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো, গঠনমূলক সমালোচনা বা
সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা।
ইহতিসাবের গুরুত্বঃ
- ১. সংগঠনকে গতিশীল করে
- ২. গীবতের পথ বন্ধ করে (হুজরাত-১২)
- ৩. সন্দেহ প্রবণতা দূর করে (হুজরাত-১২)
ইহতিসাবের উদ্দেশ্যঃ
- ১. অপরের দোষ-ত্রুটি সংশোধন করার জন্য
- ২. অপর ভাইয়ের কল্যাণ কামনায়
- ৩. সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য
ইহতিসাবের পদ্ধতিঃ
- ১. ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে সংশোধনের চেষ্টা করা
- ২. সংশোধন না হলে দায়িত্বশীলকে জানানো
- ৩. তাতেও যদি সংশ্লিষ্ট ভাই সংশোধিত না হন, তাহলে দায়িত্বশীলের অনুমতি সাপেক্ষে সামষ্টিক প্রোগ্রামে ইহতিসাব করা
ইহতিসাব করার নিয়ম-নীতিঃ
নিয়ম-নীতির ধার না ধরলে ইহতিসাব দ্বারা উপকারের চেয়ে অপকারটাই বেশি হবে। হাদীসে মুমিনকে মুমিনের জন্য আয়না বলা হয়েছে। (তিরমিযী) তাই, অন্যের সংশোধনের জন্য আমাদেরকে আয়নার মতো ভূমিকা পালন করতে হবে। যেমন-
- ১. কারো ছিদ্রান্বেষণ বা দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো উচিত নয়
- ২. পেছনে বসে সমালোচনা করা যাবে না
- ৩. সমালোচনায় কোন বাড়াবাড়ি হওয়া উচিত নয়
- ৪. সমালোচনা সম্পুর্ণ নিরপেক্ষ এবং কোনরূপ স্বার্থসিদ্ধি ও দুরভিসন্ধি থেকে মুক্ত হওয়া উচিত
- ৫. বক্তব্যটুকু বলে দেওয়ার পর তাকে আর মনের মধ্যে লালন করা উচিত নয়
- ৬. সকলের ভেতর পরনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, সহানুভূতি ও ভালবাসা ক্রিয়াশীল থাকতে হবে
যিনি ইহতিসাব করবেন তার করণীয়ঃ
- ১. মন-মানসিকতা, সময় ও পরিবেশ বুঝে ইহ্তিসাব করা
- ২. ইহতিসাবের ভাষা হবে মোলায়েম, ভাষায় কোন তেজ থাকবে না এবং ক্ষোভের অভিব্যাক্তি ঘটবে না
- ৩. আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে ইহতিসাব করা
- ৪. দরদি মন নিয়ে আন্তরিকতার সাথে ইহতিসাব করা
- ৫. হেয় করার উদ্দেশ্যে ইহতিসাব করা যাবে না
- ৬. কারণ দর্শানোর পর ঐকান্তিকতার সাথে মেনে নেওয়া এবং সবকিছু অন্তর থেকে মুছে ফেলা
যার ইহতিসাব করা হবে তার করণীয়ঃ
১. ছল-চাতুরীর আশ্রয় না নিয়ে ত্রুটির স্বীকৃতি দেওয়া
২. সংশোধনের জন্য দোয়া কামনা করা ও প্রচেষ্টা চালানো
৩. সুন্দর ভাষায় কারণ বর্ণনা করা
৪. ভুল ধারণা অন্তর থেকে মুছে ফেলা
৫. আপস-রফা এবং অভিযোগ খণ্ডনঃ
কোন মুসলমান তার ভায়ের কথা বা কাজের দ্বারা মনোকষ্ট পেলে তা থেকেই অভিযোগের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে আমাদের যত্নবান থাকতে হবে।
- এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে অভিযোগের সুযোগ না দেয়া
- অভিযোগ সৃষ্টি হলে তা অবিলম্বে অন্তর থেকে দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা
- উক্ত প্রচেষ্টার পরও অভিযোগ সৃষ্টি হলে এবং তাকে বিস্মৃত হওয়া সম্ভবপর না হলে তাকে মনের ভেতর লালন না করে অবিলম্বে ভায়ের কাছে প্রকাশ কর।
- অভিযোগকারী পেছনে গীবত না করে সংশোধনের সুযোগ করে দেয়ার কারণে তার প্রতি অসন্তুষ্ট না হয়ে কৃতজ্ঞ হওয়া
- ভায়ের মনে কোন অভিযোগ রয়েছে, একথা জানার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মসংশোধনের চেষ্টা করা। যদি সত্যিই নিজের ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে খোলা মনে স্বীকৃতি জানানো ও অনুশোচনা প্রকাশ করা
- যদি সে ত্রুটির জন্য কোন ওজর থাকলে তা পেশ করা
- মুসলমান ভাই তার ত্রুটি স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া
No comments