ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় - সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (রহ:)
(ইসলামী হুকুমত কিসতরাহ কায়েম হতে হ্যাঁ)
লেখক: সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (রহ:)
প্রথম আনুবাদক: মাওলানা আব্দুর রহিম।
১৯৪০ সালে আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ে মাওলানা মওদুদী ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্টা হবে তার উপর একটি বক্তৃতা দেন যা পরবর্তিতে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
আলোচ্য বিষয়:
- ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ।
- রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বভাবিক বিবর্তন।
- আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের প্রতিনিধিত্ব মূলক রাষ্ট্র।
- ইসলামী বিপ্লবের পদ্বতি।
- অবাস্তব ধারণা বা পরিকল্পনা।
- ইসলামী আন্দোলনের সঠিক পদ্ধতি।
- ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতি।
ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়:
- (১) বিভিন্ন পন্থা ও শ্রেণীর লোকদের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।
- (২) এ সকল পন্থার অসারতা
- (৩) অবাস্তব কল্পনা বিলাস পরিহার।
- (৪) ইসলামী রাষ্ট্রের ধরন ও বৈশিষ্ট্য ঠিক করা।
- (৫) রাষ্ট্রের কাঠামো ঠিক করে নিতে হবে-আধুনিক ও যুগোপযোগী।
- (৬) রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নিরেট বৈজ্ঞানিক পন্থায় চিন্তা করা।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন :
- ১. কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক উপায়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়
- ২. রাষ্ট্রের জন্ম ২য় একটি সমার্জে মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তা-চেতনা, মন মানসিকতা সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের সমন্বিত কর্ম প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিক নিয়মে।
- ৩. কিছুটা সামাজিক ও সামষ্টিক চেষ্টা তৎপরতা। কিছুটা আবেগ উদ্দীপনা, কিছুটা ঝোঁক প্রবণতা এমনভাবে বর্তমান থাকা চাই যার নিবিড় সমন্বয়ে স¦াভাবিক পন্থায়। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে।
- ৪. রাষ্ট্রের প্রকৃতি হয়ে সেই সমাজের পরিবেশ ও দৃষ্টিভঙ্গীর উপর যার চাপের ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র জন্ম লাভ করে।
- ৫. যে ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য সে ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বভাব ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল উপায় উপাদান সংগ্রহ করতে হবে এবং সঠিক কর্মপন্থা অবলম্বন করতে।
- ৬. যে ধরণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা উদ্দেশ্য সে রকম-
- (ক) আন্দোলন
- (খ) ব্যক্তিগত, দলীয় ও সামাজিক চরিত্র
- (গ) প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নেতৃত্ব
- (ঘ) সামাজিক কার্যক্রম ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
উপমা:
লেবু গাছ লাগানোর পর তা বড় হয়ে যেমন আম ফলাতে পারে না। ঠিক তেমনি এক ধরনের রাষ্ট্রের তৎপরতা চালিয়ে অন্য ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার আশা মূর্খতা, খামখেয়ালী, অসাড় কল্পনা ও অনভিজ্ঞতা।
আদর্শিক রাষ্ট্র:
- ১. আদর্শিক রাষ্ট্র হবে সম্পূর্ণ জাতীয়তাবাদের কলুষমুক্ত।
- ২. এ রাষ্ট্র পরিচালনায় বংশ, গোত্র, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষা নির্বিশেষে সকলেই অংশীদার হয়ে যাবে।
- ৩. খৃষ্টবাদ আদর্শিক রাষ্ট্রের অস্পষ্ট নকশা লাভ করেছিল কিন্তু আদর্শিক রাষ্টের কাঠামো লাভ করেনি।
- ৪. ফরাসী বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রে আদর্শিক রাষ্ট্রের ক্ষীণ রশ্মি দেখা দিলেও তাতে অচিরেই অন্ধ জাতীয়তাবাদ ঢুকে পড়ে।
- ৫. পৃথিবীর প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত একমাত্র ইসলাম ই পারে জাতীয়তাবাদের যাবতীয় সংকীর্ণ ভাবধারা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নিরেট আদর্শিক বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠা করতে ।
- ৬. পাশ্চাত্য ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, পৌরনীতি, অর্থনীতিতে শিক্ষিত ব্যক্তিদের দিয়ে আদর্শিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়, যদিও তারা মুসলমান হয়।
- ৭. জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র সমূহে গঠনের কর্মপন্থা ও আদর্শিক রাষ্ট্র গঠনের কর্মপন্থা কখনো এক হতে পারে না।
- ৮. আদর্শিক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হল মানুষ ও মানব জাতি।
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র:
- ১. ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত।
- ২. কোনো ব্যক্তি শ্রেণী, বংশ, জাতি এমনকি গোটা মানবজাতির ও সার্মভৌমত্বের বিন্দুমাত্র অধিকার নেই।
- ৩. এই রাষ্ট্রে মানুষ আাল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে।
- ৪. ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মহীন রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।
- ৫. ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক, ভোটার সেনা প্রধান, রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রীবর্গ সমাজ জীবনের প্রতিটি বিভাগ ইসলামী আদর্শে ঢেলে সাজাতে হবে।
খেলাফত লাভের উপায়:
- ১. সাধারন রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ইসলামী রাষ্ট্রের কেরানী হবার যোগ্য নয়।
- ২. ধর্মহীন রাষ্ট্রের পুলিশ ইনস্পেক্টর জেনারেল ইসলামী রাষ্ট্রের সাধারণ কমস্টেবল হবার যোগ্য নয়।
- ৩. ধর্মহীন রাষ্ট্রের ফিল্ড মার্শাল ইসলামী রাষ্ট্রের সিপাহী হবার যোগ্য নয়।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের গুনাবলী:
- ১. জবাবদিহীর অনুভূতি
- ২. আল্লাহর বান্দাদের উপর ইনসাফ কায়েম
- ৩. স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারীতা, বিদ্বেষ, পক্ষপাতিত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা পরিহার।
- ৪. সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলা
- ৫. দুনিয়ার উপর আখেরাতকে প্রাধান্য দেয়া ৬. সকল তৎপরতার মূল লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি
- ৭. ব্যক্তিগত ও জাতিগত অর্থের দাসত্ব পরিত্যাগ
- ৮. হিংসা, বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত
- ৯. ধন সম্পদ ও ক্ষমতার নেশা ত্যাগ
- ১০. আমানতদার ও সুবিচারক
- ১১. বিজিত হলে এরা কোন দেশে গণহত্যা ধংসলীলা ও জুলুম না করে জনগণের জান-মাল ইজ্জত আবরুর হেফাজতকারী হয়ে যাবে।
- ১২. এদের সততা সত্যবাদীতা, নৈতিকতা ও চারিত্রিক মাধুর্যের উপর গোটা বিশ্ববাসী আস্থাশীল হবে। বি:দ্র: উপরে বর্ণিত গুনগুলো যারা ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন তাদের মাঝে থাকতে হবে।
ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি:
- ১. ইসলামী জীবন দর্শন, ইসলামী জীবনের উদ্দেশ্য, ইসলামিক চরিত্র ও ইসলামের প্রাণশক্তির সহিত সামঞ্জস্যশীল আন্দোলন গঠন।
- ২. আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
- ৩. ইসলামের আলোকে একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- ৪. বিপদ মুছিবত ও অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করার এবং ত্যাগ ও কোরবানীর চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন।
- ৫. নেতা ও কর্মীদের কথা, কাজ চরিত্রের মাধ্যমে মানুষ ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ সুবিচার ও শান্তির প্রতি নিশ্চিত হবে।
- ৬. আস্তে আস্তে সৎ ও নীতিবাদ লোক আন্দোলনের অনুসারী এবং চরিত্রহীন লোক সমাজ থেকে বিলীন হওয়ার মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লব সংগঠিত হ্েব।
- ৭. সমাজের মানসিক, নৈতিক, মনস্তাত্তিক ও সংস্কৃতিকে ইসলামের আলোকে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে।
- ৮. রাসূলের (সা:) আদর্শের ভিত্তিতে একটি প্রচন্ড গণআন্দোলন উপস্থি’ত হবে।
অবাস্তব ধারণার কল্পনা:
- ১. সকল ইসলামী দল একত্রিত হলেই ইসলামী বিপ্লব সম্ভব।
- ২. মুসলিম নামক লোকের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা আসলেই ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়ে যাবে।
এই ধারণা ভুল কারণ:
- ১. মুসলিম সমাজ নৈতিক দিক থেকে চরম অধ:পতিত।
- ২. বর্তমান আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্রের যোগ্য লোক তৈরী করছেনা।
- ৩. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের জন্য যোগ্য লোকের অভাব।
- ৪. ইসলামী রাষ্ট্র একবার প্রতিষ্ঠা করে পরে শিক্ষা ব্যবস্থা ও চরিত্র সংশোধন করা যাবে।
- ৫. উমর বিন আব্দুল আজিজের মত মুহাম্মাদ তুঘলক ও আলমগীর এক বাদশাহ হারুনুর রশীদ যোগ্যতা সম্পন্ন, উন্নত দ্বীনদারীর অধিকারী ও পরাক্রমশালী হয়েও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে পারেন নি।
সমাধান:
রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়াই ত্যাগ ও কোরবানীর মাধ্যমে ব্যাপক দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক সংশোধনের মাধ্যমে।
ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতি:
১. তাওহীদকে পরিপূর্ণভাবে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে অনুধাবন করে তার আলোকে জীবন ঢেলে সাজানো। দুনিয়ার মানুষকে তাওহীদের প্রতি আহবান করা।
২. অগ্নি পরীক্ষায় নিখাদ প্রমাণিত হওয়া ফায়দা:
- ১. ভীরু, কাপুরুষ, চরিত্রহীন ও দুর্বল প্রকল্পের লোক আন্দোলনে ঘেষতে পারে না।
- ২. যারা অংশগ্রহণ করেছে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই করেছে।
- ৩. যারা শরীক হয় তারা নানা ঘাত-প্রতিঘাতে যথার্থ প্রশিক্ষণ পায়। দিন দিন বাড়াতে থাকে আন্দোলনের লোক।
- ৪. রাসূল (সাঃ) এর সমগ্র জীবনের অনুসরণ। নেতা ছিলেন আদর্শের মডেল।
- ৫. আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপ্লব ইসলামী আদর্শের আলোকে মানুষের মন মগজ, চিন্তা-চেতনা,আচারআচরণ, কাজ-কর্ম সবকিছু ঢেলে সাজাতে পারলে তার স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হল ইসলামী বিপ্লব।
কোন মন্তব্য নেই