• তাজা খবর

    নারী উদ্যেক্তার সাহসী আত্মকাহিনী- ফারজানা মাহবুবা

     মানুষ ডেষ্টিনেশানে পৌঁছে গেলে পিছনের গল্প বলে বা লিখে।

    আমার কাছে সবসময় ডেষ্টিনেশানের চে' জার্নিটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

    জুন মাস থেকেই ভাবছিলাম গত এক বছরের বিজনিস ক্যারিয়ারের জার্নিটার র’/ তাজা অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখি।
    Success story

    জুন চলে গেলো
    জুলাই চলে গেলো
    অগাষ্টও প্রায় চলেই যাচ্ছে,
    এই লেখা আর হয়ে উঠছিলো না।

    যেহেতু একাডেমিক ক্যারিয়ার থেকে বিজনিস ক্যারিয়ারে সুইচ করেছি
    তাই চাইলেও এই দুই ক্যারিয়ারের মধ্যে তুলনা করা এভয়েড করতে পারি না। 

    এই দু’টো ক্যারিয়ারই আমাকে একটা জিনিষ খুব ভাল করে শিখিয়েছে-
    একজন মেয়ের জন্য যে কোনো ক্যারিয়ারেই চারটা P খুব খুব খুব দরকারী;
    Priority, Passion, Persistence, Patience. 

    যারা আমাকে ভয় দেখিয়েছিলেন, অনুৎসাহিত করেছিলেন এই বলে যে ‘বিজনিসের ব-ও বুঝো না, এই লাইনে নামছো, বুঝবে ঠ্যালা’,
    আলহামদুলিল্লাহ শুধুমাত্র এই চার P-কে অলংঘনীয় সূত্রের মত ধরে রেখে
    একটা ছয় বছরের মাত্র স্কুল শুরু করা বাচ্চা
    আরেকটা কোলে, তখনো বুকের দুধ খাওয়া দেড় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে
    বাসার-ই সবচে’ ছোট রুমটাতে বিজনিস শুরু করে 
    আজকে এক বছরের মাথায়
    অনলাইনে এবং লোকাল কাষ্টমার সার্কেলে একটা রানিং বিজনিস চালাচ্ছি।
    না, বিজনিসের একাডেমিক ভাষায় রানিং বিজনিস কাকে বলে আমি জানিনা;
    আমার সংজ্ঞা অনুযায়ী যে বিজনিসের একটা স্ট্রং এবং রেগুলার কাষ্টমার বেইস আছে
    প্লাস যে বিজনিসের নিজের টাকায় বিজনিসটা নিজেই চলছে,
    নতুন করে কোনো ফাইনানশিয়াল ইনপুট দিতে হচছে না
    সেটাই রানিং বিজনিস।
    আমার বিজনিস’র জায়ান্ট প্ল্যানকে সামনে রেখে দেখলে এই একবছরে বিজনিসটাকে এই রানিং স্টেইজে এনে দাঁড় করানো স্রেফ ছোট্ট একটা এক পা এগুনো হয়তো,
    বড় বড় বিজনিস পার্সনরা আমার এই রানিং বিজনিসের সংজ্ঞায় হয়তো হেসে ফেলবে,
    কিন্তু
    টু মী-
    সত্যি কথা বলতে আমি ভেবেছিলাম এই অবস্থায় আসতে আমার কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর লাগবে!
    আলহামদুলিল্লাহ আই ডীড ইট ইন ওয়ান ইয়ার। 

    প্রথম বাচ্চা কোলে পিএইচডি করে ফেলার পরও নিজের যে হারানো আত্মবিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনতে পারিনি
    গত এক বছরের বিজনিস আমাকে সেই আত্নবিশ্বাস শুধু ফিরিয়েই দেয়নি
    আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতেও শিখিয়েছে।

    একাডেমিক লাইনে থেকে আমি যে গবেষনা করতে চেয়েছিলাম,
    ইনশাআল্লাহ “যদি” বিজনিসে লেগে থাকি তাহলে
    একদিন এমন সময় আসবে যখন একজন ফারজানার অসমাপ্ত গবেষনার এগেইন্সটে একশ’জন ফারজানার গবেষনাকে স্কলারশিপ দিবে এই বিজনিস।

    ভাবছেন খুব দুঃসাহসী স্বপ্ন?
    সে হবে হয়তো!
    আমার নিজের স্বপ্ন, তা যতই দুঃসাহসী হোক, অন্যের সাথে শেয়ার করতে খুব ভাল লাগে।
    কারন আমি জানি,
    আমার মত প্রচুর মেয়ে/মহিলা আছে যারা স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়।
    আমার তাদেরকে ডেকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে
    এক জীবনে যে স্বপ্ন দেখতে মন চায়
    সেগুলোকে এভাবেই অসূর্যাস্পর্শা রেখে দিয়ে
    মনের ভিতরের সেই বিশাল সিন্দুকে তালা বন্ধ করে রেখে দিয়ে
    সাথে করে কবরেই নিয়ে যাবেন??
    কী লাভ হলো তাহলে আপনার এই জীবনের?

    সেইতো গৎ বাঁধা সূত্রের মত ঘুম-দৈনন্দিন জীবন, ঘুম-দৈনন্দিন জীবন, ঘুম-দৈনন্দিন জীবন করে করে বুড়িয়ে যাচ্ছেন
    ফুরিয়ে যাচ্ছেন
    কবরে চলে যাচ্ছেন,
    এ কেমন জীবনকে যাপন?!

    আমার প্ল্যান ইনশাআল্লাহ ২০১৯ থেকে যদি নাও পারি ২০২০ থেকে অবশ্যই, ইনশাআল্লাহ, স্কলারশিপ প্রোগ্রাম চালু করা।
    রাজনীতি, ধর্ম, আর জেন্ডার নিয়ে আমার যে অসম্ভব উৎসাহ,
    সেই ফিল্ডে মেয়েদেরকে আনতে চাই আমি। 
    শত শত মেয়েরা রাজনীতি, ধর্ম আর জেন্ডার নিয়ে তুলকালাম চিন্তাভবনা করে এক্সিস্টিং বিভিন্ন পাওয়ার ডাইনামিক্সকে চ্যালেঞ্জ করুক - চাই আমি।

    তাছাড়া সেই ক্লাস ফাইভ থেকে স্কলারশিপ পেয়ে পেয়ে পিএইচডি করেছি
    এখন আমার সে ঋণ শোধের পালা আসছে সামনে,
    ইনশাআল্লাহ।

    জিজ্ঞেস করতে পারেন,
    এত প্রস্পেক্টিভ একাডেমিক ফিল্ড ছেড়ে দিয়ে
    বিজনিস ফিল্ডে এসে আমার আক্ষেপ হয়নি কখনো?

    না, আক্ষেপ হয়নি,
    কিন্তু প্রথম দিকে খুব হাহাকার লাগতো।
    এখানকার ইউনিগুলোতে প্রফেসরদের রুমগুলো স্বপ্নের মত হয়।
    সিলিং থেকে ফ্লোর অবধি বইয়ের থাক
    বই আর বই আর বই আর বই...
    তারমধ্যে রুমগুলো সাধারনতঃ এমনভাবে করা হয় যেন বড় জানালার ওপাশেই প্রচুর সবুজ দেখা যায়।
    এক একটা প্রফেসরের রুমে গেলেই মনে হতো
    একদিন আমিও এমন একজন প্রফেসর হবো
    আমারো এমন একটা রুম থাকবে
    যে রুমে ঢুকলে খালি পড়তেই মন চাইবে!
    যে রুমে ঢুকলে স্টুডেন্টসদের মনে হবে তারা যেন কোনো বুড্ডিষ্ট মেডিটেশান স্যাংচুয়ারীতে ঢুকে পড়েছে...
    যেখানে স্টুডেন্টস হোক বা কলিগ
    আড্ডা হবে শুধু বই, কফি আর সবুজ গাছের ভিতর।

    সেই স্বপ্নটাকে ছেড়ে আসার হাহাকার টের পেতাম বুকের ভিতর।
    কিন্তু আস্তে আস্তে হাহাকারটা পাতলা হতে হতে হারিয়ে গিয়েছে
    যখন প্রফেসর হওয়ার স্বপ্নটাকে রিমডেলিং করে
    নিজে প্রফেসর না হয়ে তার বদলে অন্যদেরকে প্রফেসর বানানোর স্বপ্নের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি।

    তাছাড়া আমার সেই ছোটবেলার
    দুনিয়া ঘুরে দেখার ইচ্ছেটাতো আছেই!
    কাঁধে ব্যাকপ্যাক, পায়ে ক্যাডস আর মাথায় স্কার্ফ বেঁধে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সেই অদম্য শখ...

    একাডেমিক লাইনে থাকলে কনফারেন্স আর ওয়ার্কশপের সুবাধে দেশ বিদেশে যাওয়ার চান্স হলেও
    এটার রিসিট রাখো
    ওটার রিসিট রাখো
    এটার ডিটেইলস জমা দাও
    ওটার ডিটেইলস জমা দাও
    হাজার রকম পেপার ওয়ার্কস থাকে এক একটা ট্রীপের পর।
    কিন্তু সেই একই ঘুরে বেড়ানো যখন নিজের বিজনিস’র কাজে করবো ইনশাআল্লাহ
    তখন আমার বনে আমিই রাজা!
    পেপার ওয়ার্কস’র খ্যাতা পুড়ি!

    যে অনেকগুলো কারনে এত ভয়ংকর শখের একাডেমিক লাইন ছেড়ে বিজনিসে শিফট করেছি,
    আলহামদুলিল্লাহ গত এক বছরের একবারও রিগ্রেট করিনি।
    বরং প্রতি পদে পদে বার বার আলহামদুলিল্লাহ বলি যে আল্লাহ আমাকে শক্ত রেখেছিলেন এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়।
    বিদেশে ফার্ষ্ট জেনারেশন একজন মা’র
    যে কিনা বাচ্চা রেখে যে টয়লেটে যাবে এমন একটা মানুষ নেই আশেপাশে
    তার ক্যারিয়ারে যে সুপার ডুপার ট্রুপার ফ্লেক্সিবিলিটি দরকার
    সেই ফ্লেক্সিবিলিটি আমাকে দিয়েছে বিজনিস।

    তবে রিগ্রেট না করলেও
    বেশ অনেকবার সন্দেহ হয়েছিলো আমি পারবো কিনা।
    অনুৎসাহিত করার জন্য বলুক
    বা যে কারনেই বলুক,
    কথা তো সত্যি যে আমি বিজনিসের ব-ও জানতাম না।

    যাদের কাছ থেকে বিজনিসের মেন্টরিং আশা করেছি
    ঠিক একাডেমিক লাইনে যেমন দেখেছিলাম
    এখানেও হুবুহু একই অভিজ্ঞতা-
    আমাদের কমিউনিটিতে মেন্টরিং নেইই বলতে গেলে।
    উলটো কেমন যেন সন্দেহ,
    যেন পুরান পাগলের ভাত জোটে না, এখন নতুন পাগলের আমদানী!
    এই এটিচ্যুড তাও নাহয় সয়ে যাওয়া যায়,
    কিন্তু চরম ইরিটেটিং লাগে যখন কেউ একজন একটা দু'টা উপদেশ দিয়েই ভাবে সে আপনার বিজনিসকে যেন কিনে নিয়েছে!
    তার তিন নাম্বার উপদেশ না শুনলেই বেজার!
    যেন আপনি তার সাথে বিট্রে করেছেন!

    আমার কাছে লিটারালি মনে হতো যেন এই মানুষগুলো আমার স্বপ্নকে আমার থেকে কেঁড়ে নিচ্ছে!
    এমনকি দুই কথা তিন কথা চার কথা'র পরে তো কেউ কেউ বলেই বসে
    ঠিক আছে আপনার বিজনিসের তাহলে এত পার্সেন্ট শেয়ার দিন, আমি অমুক অমুক দিক দেখবো।
    লে বাবা,
    অনেকটা যেন
    জিজ্ঞেস করেছি, ভাই আমার মেয়ের এই অসুখ, কী করতে পারি,
    তার উত্তর দিচ্ছে- ঠিক আছে আপনার মেয়ে আমাকে অর্ধেক দিয়ে দিন, আমি অসুখ ঠিক করে দিচ্ছি!!

    অনলাইন বিজনিস সম্পর্কে টোটালি অজ্ঞ ছিলাম বলে
    এইজনে বলে 'লেজার টার্গেটিং ছাড়া ফেইসবুকে বিজনিস হয় নাকি?!'
    ঐজনে বলে 'ডিজিটাল মার্কেটিং এর এটা না জানলে ওটা না জানলে অনলাইন বিজনিস করবেন কী করে?!'

    আমি ভয়ে আর আশংকায় গুটিয়ে যেতাম।
    যে যা বলতো তাইই শিখে ফেলতে চাইতাম।
    তারপর বছর যেতে যেতে একদিন রিয়েলাইজ করলাম,
    বাছারা যারা এমন ভয় দেখায়
    তারা নিজেরা কী?!
    এদের কেউ কি রিয়েল লাইফে বিজনিস করে?
    নাতো!
    তাহলে কেনো এভাবে ভয় দেখায়?
    কারন আর কী,
    বাংগালীর স্বভাব!

    বিজনিসের একবছর যেতে যেতে একটা বিষয় আমি খুব ভালভাবে বুঝে নিয়েছি; তা হলো, ওয়ার্ড অফ মাউথ। 

    হ্যা, অবশ্যই আপনার ডিজিটাল মার্কেটিং সম্পর্কে একটা মিনিমাম জ্ঞান লাগবে অনলাইন বিজনিস করতে হলে,
    ফেইসবুকে বিজনিস দাঁড় করাতে হলে লেজার টার্গেটিং সম্পর্কেও এটা সেটা জানতে হবে,
    কিন্তু এগুলো সবই হলো আশেপাশের হেল্পিং টুলস।
    একটা বিজনিসের মেইন মেরুদন্ড হলো- আপনার রিয়েল কাষ্টমারের রিয়েল ফীডব্যাক।
    একজন হ্যাপি ক্যাষ্টমার যে পাবলিসিটি করবে আপনার,
    হাজার হাজার ডলার খরচ করেও অনেক ক্ষেত্রে আপনি সেই পাবলিসিটি পাবেন না।

    আমার বিজনিসের অন্যতম ইন্সপিরেশান হলো আমার কাষ্টমাররা।
    অনেক সময় এমন হয়
    অনেক প্রডাক্ট আমি পেইজে আপলোড-ই করতে পারি না,
    একজনের মুখে আরেকজন শুনে শুনে কিনতে কিনতে প্রোডাক্ট শেষ! 

    কখনো যদি বড় বড় ক্রুজ শিপগুলোতে যান,
    দেখবেন ওরা আপনাকে এমনভাবে ভিভিআইপি টেইক কেয়ার করবে
    আপনি ক্রুজ থেকে ফিরে ওদের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবেন!
    আমি আর আমার জামাই এক ক্রুজে গিয়ে
    কতজনের কাছে যে সেই ক্রুজের প্রশংসা করেছি,
    আমাদের থেকে শুনে আরো কয়েকজন কাপল অলরেডী ঘুরে এসেছেন।
    এখন তারাও এত হ্যাপি,
    উনারা যখন ক্রুজের গল্প করেন
    উনাদেরকে উলটা মনে করিয়ে দিতে হয়, ভাই এবার থামেন! আমরাও একই ক্রুজেই গিয়েছিলাম!

    একেই বলে ওয়ার্ড অফ মাউথ।

    তবে হ্যা,
    কয়েকবার আমার মনে হয়েছে আমাকে দিয়ে এই বিজনিস করাও বুঝি সম্ভব হবে না।
    ছেড়ে দেই বিজনিসও।

    লাষ্ট এটা মনে হয়েছিলো এই রোজার ঈদের আগের দিন।

    যেহেতু রোজার সময় বিজনিসের খুব বিজি সময়,
    মেয়েদের বাবাও ছিলো না, 
    সেদিন শোরুম বন্ধ নোটিশ দেয়ার পরও লোকাল আপু, আন্টি, ভাবীরা এমনভাবে আসছিলেন
    আমি যে নিজের জন্য ইফতার খেতে কিছু রেডী করবো তারও সময় পাচ্ছিলাম না।
    আর ছোটু তো যথারীতি সারাক্ষন কোলে।
    ব্যাক পেইনের যন্ত্রনায় তাকে কোল থেকে নামালেই
    একটু ঘুরে এসে আবার আমার গায়ের কাপড় টেনে ধরে ঘ্যান ঘ্যান
    ‘মাআ, তোএ! মাআআআ, তোএএএ!’ 
    এক পর্যায়ে শো-রুম খোলা রেখেই
    ফ্রীজে আগের দিনের যে ভাত তরকারী ছিলো তাইই গরম করে নিয়ে যেই ইফতার করতে বসেছি,
    বডডা টয়লেটে যাবে!
    তার ভয় লাগছে অতএব তার টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে!
    সে টয়লেট করছে,
    তার টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইফতার করছি
    আর ছোটু কাপড় টেনে ধরে কেঁদে যাচ্ছে, ‘মাআআ! তোএএএ পীইইইশ!’
    কোনোরকমে দুইতিন লোকমা মুখে দিয়ে একহাতে প্লেইট ধরে রেখেই আরেক হাতে ছোটুকে কোলে নিতে উপুড় হয়েছি
    বড্ডা হুড়াহুড়ি করে টয়লেট থেকে বের হতে গিয়ে আমার হাতের সাথে লেগে প্লেইটটা পড়ে গেলো।

    বড্ডার ভয় পাওয়া চেহারা
    ছোটুর আরো জোড়ে চিৎকার করে কান্না
    ক্ষুধার্ত আমার এঁটো হাত
    ফ্লোর জুড়ে ভাংগা কাঁচের প্লেইটের টূকরা আর ছড়ানো ভাত তরকারী...
    নিজেই কিছু বুঝে উঠার আগেই
    নিজেই কাঁদতে লাগলাম!

    আমার কান্নায় বেকুব হয়ে ছোটু’র কান্না বন্ধ!
    সে ভীত স্বন্ত্রস্থ হয়ে তার বড়বোনের পাশে গিয়ে বড়বোনের জামা ধরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো আমাকে!

    কাঁদছি আর ফ্লোরের কাঁচের টুকরো আর ভাত তরকারী পরিষ্কার করছি,
    আর ভাবছি
    আমি কী ভুল করলাম?
    বিজনিস করার সিদ্ধান্তটা কি ভুল ছিলো?
    দুই বাচ্চা নিয়ে আমি কি পারবো এই জার্নিতে টিকে থাকতে?

    এই যে কনফিউশান
    এই যে ক্যারিয়ার নিয়ে নিজের ভিতর নিজের দ্বন্দ
    পৃথিবীর প্রত্যেকটা ক্যারিয়ার-মাম জানে
    এই দ্বিধা, এই সংশয়, এই কনফিউশান মাতৃত্বের অনেক বড় একটা অংশ।
    বিশেষ করে যখন আশেপাশের সবাই আংগুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিতে থাকে
    কীভাবে একজন ক্যারিয়ার-মাম’র ক্যারিয়ার তার সন্তানদের “ক্ষতি” করছে!
    যেন ক্যারিয়ার-মাম মানেই খারাপ মা!
    ব্যাড-মাম!
    যখন খুব কাছের কেউও বলে বসে ‘তোমার কাছে তো তোমার বাচ্চাদের চেয়ে তোমার কাজ বড়!’

    হ্যা, যখন এমন সারাদিনের রোজা রাখা ক্ষুধা নিয়ে
    কোলে উঠার জন্য কাঁদতে থাকা বাচ্চাকে ইগনোর করে
    অর্ধেক খাওয়া পেটে
    ফ্লোর থেকে কাঁচের টুকরা আর ভাত তরকারী পরিষ্কার করতে হয়, 
    তখন কনফিউশান না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।

    এটা তো স্রেফ একটা উদাহরন।

    ঠিক পিএইচডি করার সময় যেমন সবাই ঘুমিয়েছে নিশ্চিন্ত হয়ে 
    চোরের মত চুপি চুপি উঠে পা টিপে টিপে অন্য রুমে গিয়ে পড়তাম
    আর সারাক্ষন এলার্ট থাকতাম বাচ্চার কান্নার আওয়ায পেলেই সুপারসনিক গতিতে শাঁইইইইইইইইই করে এসে পাশে শুয়ে যেতাম
    যেন বাচ্চা আমি যে পাশে ছিলাম না তা টের পাওয়ার আগেই আমাকে খুঁজে পায়
    সেই হুবুহু একইভাবে বিজনিসটাকে দাঁড় করিয়েছি রাত জেগে জেগে।
    গ্যারেজ কাম শোরুমে পেপার ওয়ার্ক করতে করতে
    প্রোডাক্টস সর্ট আউট করতে করতে
    খরগোশের মত কান খাঁড়া করে রেখেছি বেডরুমের দিকে
    কখন বাচ্চা কেঁদে উঠে আর আমাকে নিঃশব্দে ভূতের মত দৌঁড় দিতে হয়!

    শুধু তো সন্তান না,
    সংসার আর সামাজিকতাও তো ঠিক রাখতে হয়।
    মা-দের ক্যারিয়ার এই এক জিনিষ,
    ক্যারিয়ার না থাকলে তাও কখনো সখনো একটু আধটু হলেও গা হাত পা এলিয়ে দেয়া যায়,
    কিন্তু ক্যারিয়ার যাদের আছে
    তাদের উলটা আরো বেশী মেপে মেপে চলতে হয়
    যেন একটু চুন থেকে পান খসলেই কেউ তার ক্যারিয়ারের দিকে আংগুল তুলে না দেখায়!

    এই যে এক ক্যারিয়ার নিয়ে যুদ্ধ,
    পিএইচডি করার সময় যেমন মাঝে মাঝেই মনে হতো ছেড়ে দেই,
    গত এক বছরে এমন বেশ কয়েকবারই মনে হয়েছিলো
    ছেড়ে দেই।
    সব বাদ।
    আর পারবো না।

    কিন্তু না,
    নিজের ভিতর কিছু করার যে প্যাশন, সেই প্যাশন আমাকে ছাড়তে দেয়নি।

    তবে প্যাশনের আগেও প্রায়োরিটিকে রেখেছি।
    যখন-ই এমন কোনো সিচুয়েশান হয়েছে
    যেখানে বাচ্চাদের সাথে বিজনিসের কিছু ক্ল্যাশ করছে,
    নির্দ্বিধায় বাচ্চাদেরকে প্রায়োরিটি দিয়েছি।
    কারন আমার লাইফের প্রায়োরিটি লিষ্টে বাচ্চারা সবার আগে।

    বড্ডাকে সন্ধ্যার পরে পড়াতে বসাতে হয়
    তার ক্যারাটে ক্লাস, এরাবিক ক্লাস, লাইব্রেরী এগুলোতেও আনা নেয়া,
    এগুলো তো আমাকেই করতে হবে,
    অতএব শোরুমের ওপেনিং টাইমকে কমিয়ে দিতে একবারও ভাবিনি।
    অফলাইনে, লোকাল মার্কেটে প্রচন্ড ডীমান্ড থাকার পরও
    বিজনিসকে মোটামুটি অনলাইন করে ফেলতেও একটুও দ্বিধা করিনি।
    লোকাল মার্কেটে
    যেখানে আমি যদি স্রেফ শোরুম ওপেনিং আওয়ার বাড়িয়ে দেই
    তাহলেই বিজনিস এক লাফে দ্বিগুন ইনকামে চলে যাবে
    সেখানে নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করেছি- আমি কি স্রেফ প্রফিট করার জন্য বিজনিসে নেমেছি?
    প্রায়োরিটি লিষ্ট সাথে সাথে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে-
    বিজনিস প্রফিট আমার বিজনিস ড্রীমেরও নীচে।
    আর বিজনিস ড্রীমস আমার সন্তানদের চেয়ে অনেক অনেক নীচে।
    অতএব, ইনকাম বাড়ানোর লোভকে আর এক বিন্দু আগে বাড়তে দেইনি।

    আল্লাহ যেমন এই এক বছরে আমার বিজনিসকে রানিং বিজনিসে নিয়ে এসেছেন,
    ইনশাআল্লাহ আল্লাহ চাইলে একসময় না একসময় এই বিজনিস বড় বিজনিস হবে।
    আমার তাড়াহুড়া না করলেও চলবে।
    জাষ্ট লাইক এনি আদার ক্যারিয়ার মাম,
    দরকার শুধু শেষের তিনটা P-কে আঁকড়ে ধরে রাখা।
    Passion, Persistence আর Patience.
    প্যাশনের কোনো অভাব নেই আমার,
    লেগেও আছি জোঁকের মত,
    এখন ধৈর্য্যে কুলালেই হয়,
    ভবিষ্যতে তাহলে কোনো একদিন হয়তো গালভরা গল্প শোনাতে পারবো, 
    কেনো এবং কীভাবে একজন প্যাশনেট একাডেমিক থেকে প্যাশনেট বিজনিস পার্সন হয়ে গেলাম!

    #Mumtrepreneur
    #LearningBusiness
    #1yearReview

    কোন মন্তব্য নেই